দেশে প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে। কোন কোন দিন একাধিক দুর্ঘটনাও ঘটছে এবং তাতে জানমালের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।এসব দুর্ঘটনার মধ্যে কিছু প্রাকৃতিক আছে, যা ঠেকানো কঠিন। তবে, সতর্ক হলে ক্ষতি কিছু কম হয়। আর বেশিরভাগ দুর্ঘটনা অপ্রাকৃতিক তথা মানবসৃষ্ট, যা সতর্ক হলে কিংবা প্রতিকার করলে ঠেকানো–কমানো সম্ভব।কিন্তু তা হচ্ছে না। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। অনবরত নানা ধরণের দুর্ঘটনা ঘটছে এবং তাতে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তাতে রাষ্ট্রের, সরকারের ও সমাজের কর্ণধাররা শোকবাণী দিচ্ছেন, দুর্ঘটনা রোধ করার সংকল্প ব্যক্ত করছেন, ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন, তদন্ত কমিটি হচ্ছে, মামলা হচ্ছে, দেশবাসী ব্যাপক শোক পালন করছে। কিন্তু তাতে দুর্ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে এবং তা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দেশে মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনা হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনা, নৌ দুর্ঘটনা, ট্রেন দুর্ঘটনা, ভূমিধ্বস ইত্যাদি। এছাড়া, প্রায়–ই হাট–বাজার, মার্কেট, বাড়ীঘর, বিভিন্ন স্থাপনা ইত্যাদিতে অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। যার অনেকগুলো ভয়াবহ।এমনই এক অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে গত ২৯ ফেব্রুয়ারির রাত পৌনে ১০টায় রাজধানীর অত্যন্ত নামী–দামী এলাকা, বেইলি রোডে অবস্থিত গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে। তাতে ৪৬ জন নিহত ও ৩৮জন দগ্ধ হয়েছে। এছাড়া, ৮৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত, আহত ও উদ্ধারকৃত ব্যক্তিদের কেউ প্রখ্যাত স্কুলের শিক্ষিকা, কেউ বুয়েটের শিক্ষার্থী, কেউ প্রবাসী ব্যবসায়ী, কেউ সাংবাদিক, কেউ শিশু, কেউ নারী। তাঁরা সেখানে খেতে গিয়েছিলেন। এই হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনার খবর দেশ–বিদেশের মিডিয়ায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে এবং দেশে সর্বাধিকভাবে আলোচিত হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রধান খবর হচ্ছে, ভবনটি ৭তলা বিশিষ্ট।সব তলাই বাণিজ্যিকভাবে চলছিল। কোন আবাসিক ছিল না। বেশিরভাগ তলায় ছিল হোটেল– রেস্তোঁরা। ভবনটির নিচতলায় আগুনের সূত্রপাত ঘটে। সেখানে অনেকগুলো গ্যাসের সিলিন্ডার মজুত ছিল, যা একযোগে বিস্ফোরিত হয়। ফলে আগুন খুব দ্রুত সমগ্র ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। ভবনটিতে রেস্তোঁরা করার কোন অনুমোদন ছিল না। অগ্নি নির্গমন পথ ছিল না। ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না। ভবনে কোন ভেল্টিলেশন নেই। সিঁড়ি একটি এবং তাও খুব সরু। আগুন লাগার পর বিদ্যুৎ ও লিফট বন্ধ হয়ে যায়।ভবনটি নির্মাণে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা এবং বিএমডিসি পালন করা হয়নি। ঝুঁকিপূর্ণ বলে তিনবার চিঠি দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর। দুর্ঘটনার পর কয়েকজন ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার ও মামলা করা হয়েছে। এ দুর্ঘটনায় দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন শোকবাণী দিয়েছে। বিষয়টি জাতীয় সংসদেও আলোচনা হয়েছে। উল্লেখ্য, বেইলি রোডের ঘটনার পর থেকে গত ৫ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৭–৮টি স্থানে আগুন লেগেছে। তন্মধ্যে চট্টগ্রামস্থ এস আলম সুপার রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে আগুন লেগে প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন চিনির কাঁচামাল পুড়ে গেছে।
বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর দেশের অতীতের দুর্ঘটনার খবরের কিয়দংশ প্রকাশিত হয়েছে, ফায়ার সার্ভিস ও বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এক খবরে বলা হয়েছে, গত ৯ বছরে (২০১৫–২০২৩ সাল পর্যন্ত) এক লাখ ৯০ হাজার ১৬৭টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে এক হাজার ৫১ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে তিন হাজার ৬০৬ জন।বিআরটিএ বলেছে, গত বছরে সড়কে ঝরেছে ৫০২৪ প্রাণ। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, দেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। একই সময়ে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত জিডিপির ক্ষতি হচ্ছে ৫.৩%।বড় অগ্নিকাণ্ডের সব মামলা হিমঘরে। সম্প্রতি প্রকাশিত দুর্ঘটনার উৎসের খবর হচ্ছে, জরাজীর্ণ সেতু দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার চলছে। নামীদামী রেস্টুরেন্টে ফায়ার সেফটির বালাই নেই। দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে ঢাকা। চট্টগ্রামে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার তোয়াক্কা করে না ভবন মালিকরা। ঢাকার বহুতল বাণিজ্যিক ভবনগুলো অগ্নিকাণ্ড ঝুঁকিতে রয়েছে। গাজীপুরে ট্রেনে কাটা পড়ে দুইজনের মৃত্যু। দাঁড়িয়ে থাকা অটোরিকশায় ট্রাকের ধাক্কা, নিহত ২। ফায়ার সার্ভিসের বিশেষ জরিপ রিপোর্ট মতে, ঢাকার ৯৬% বিপণীকেন্দ্র, ৯৮% শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৯৮% হাসপাতাল–ক্লিনিক অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া, চট্টগ্রামে আগুনের ঝুঁকিতে রয়েছে ৫৪.২৯% ভবন। অগ্নিঝুঁকিতে রাজশাহীর পাঁচ মার্কেট। দেশের অন্য শহরের অবস্থা কম–বেশি একই! তাই সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা জিএম কাদের, এমপি বলেছেন, পুরো দেশটাই যেন অগ্নিঝুঁকিতে। দুর্ঘটনা সংক্রান্ত ডয়চে ভেলের টকশো–তে গ্লোবাল টেলিভিশনের প্রধান স¤পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, বাংলাদেশের একটা প্রতিষ্ঠানও কাজ করছে না, সবগুলো ভেঙ্গে পড়েছে। ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক, একেএম শাকিল নেওয়াজ এক নিবন্ধে বলেন, আমরা কেউ নিরাপদ নই, হাসপাতাল শপিং মল, রেস্টুরেন্ট– কোথাও না। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান বলেন, আইন লঙ্ঘন করে ভবন মালিকেরা বছরের পর বছর ব্যবসা চালিয়ে যাবে এবং মানুষকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলবে, এটা চলতে পারে না। প্রয়োজনে টাস্কফোর্স গঠন করে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। তাঁদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। অন্য বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী শুধু অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেওয়া বাধ্যতামূলক করলে সব অনিয়ম রাতারাতি ঠিক হতে বাধ্য।কারণ, অকুপেন্সি সার্টিফিকেট হলো ভবন ব্যবহার করার অনুমতিপত্র। রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সরেজমিন যাচাই করার পর এ সনদ দিবে। এই সনদ ছাড়া কোনো সেবা সংস্থার ইউটিলিটি সেবা তথা গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দিতে পারবে না। গত ৫ মার্চ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, দুর্ঘটনা এড়াতে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে সমন্বয় করে রাজধানীর অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া, তারানা হালিম,এমপি বলেন, ঝুঁকি এড়াতে পুরানো ঢাকার কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিগুলো সরিয়ে নিতে হবে।একই দিনে বাপা, বিআইপি ও বেলা আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা বলেন,ভবনে অগ্নিকাণ্ড ও এসব ঘটনায় হতাহতের জন্য অনুমোদন প্রদানকারী সাতটি সংস্থার(উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, ওয়াসা, তিতাস, ডিপিডিসি/ডেসা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী) দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং ভবন মালিককে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের আসামি করে আইনের আওতায় আনতে হবে। গত ৫ মার্চ রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, আগামী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে রাজধানীর অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করা হবে।