প্রতিবেদনে প্রকাশিত বিপুল সম্পদের মধ্যে রয়েছে গোপালগঞ্জের সাহাপুর ইউনিয়নে সাভানা ইকো রিসোর্ট নামের এক অভিজাত ও দৃষ্টিনন্দন পর্যটনকেন্দ্র। সেখানে এক রাত থাকতে গুণতে হয় অন্তত ১৫ হাজার টাকা। দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে কালের কণ্ঠ জানতে পেরেছে, একক পরিবারের জন্য বানানো এসব কটেজের পেছনে ব্যয় হয়েছে অর্ধকোটি টাকার বেশি। যাতায়াতের জন্য সরকারি খরচে বানানো হয়েছে সাত কিলোমিটারের চেয়ে বেশি দীর্ঘ পাকা সড়ক। পুলিশ ক্যাম্পও বসানো হয়েছে সেখানে।
বেনজীর আহমেদের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান করা হবে কিনা জানতে চাইলে দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। কমিশন বৈঠকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমি চাইলেই তো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। কমিশন বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ফলে পরবর্তী কমিশন বৈঠকে এ ব্যাপারে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো।’
কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, পুলিশের সাবেক প্রভাবশালী শীর্ষ কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদের স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ছয়টি কোম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে। পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়, ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতে বেনজীর আহমেদের দামি ফ্ল্যাট, বাড়ি আর ঢাকার কাছের এলাকায় বিঘার পর বিঘা জমি রয়েছে। দুই মেয়ের নামে বেস্ট হোল্ডিংস ও পাঁচতারা হোটেল লা মেরিডিয়ানের রয়েছে দুই লাখ শেয়ার। পূর্বাচলে রয়েছে ৪০ কাঠার সুবিশাল জায়গাজুড়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি, যার আনুমানিক মূল্য কমপক্ষে ৪৫ কোটি টাকা। একই এলাকায় আছে ২২ কোটি টাকা মূল্যের আরও ১০ বিঘা জমি। অথচ ৩৪ বছর সাত মাসের দীর্ঘ চাকরিজীবনে বেনজীর আহমেদ বেতন-ভাতা বাবদ মোট আয় এক কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকার মতো হওয়ার কথা।
কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হায়দার আলী ও ফরিদ আহমেদ। অনুসন্ধানী সেলের প্রধান হায়দার আলী বলেন, ‘আমরা দুই মাস অনুসন্ধান করে তথ্য-উপাত্তের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি।’
বেনজীর আহমেদ পদে থাকার সময় এই প্রতিবেদন প্রকাশ না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব সময় তো চাইলেই সব প্রতিবেদন করা যায় না। আবার নিজের অফিসেও কিছু বিষয় আছে। ফলে আমরা তথ্য-উপাত্ত নিশ্চিত হওয়ার পরই প্রতিবেদন করেছি। সামনে আরও পর্ব আছে। সেসব তথ্য আমরা যাচাই-বাছাই করছি, যাতে কোনো ধরনের ভুল তথ্য চলে না যায়।’
প্রতিবেদন প্রকাশের পর কোনো হুমকি পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে হায়দার আলী বলেন, ‘ওভাবে কোনো হুমকি পাইনি। তবে আমাদের সাংবাদিক সহকর্মীদের অনেকে অনেক রকম কথা বলছেন। আমি আগেও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছি। সেখানেও আমি দেখেছি, সত্য তথ্য তুলে ধরলে কারও কিছু বলার থাকে না। আর মিথ্য লিখলে অনেকেই হুমকি-ধামকি দেন। একেবারে যে পাইনি সেটা বলা যাবে না। তবে সেগুলো আমি প্রকাশ করতে চাচ্ছি না।’
কালের কণ্ঠের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাভানা ইকো রিসোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বেনজীরের বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর এবং পরিচালক ছোট মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে রয়েছে বেনজীর আহমেদের অঢেল সম্পদ। গোপালগঞ্জে সাভানা ফার্ম প্রডাক্টস, সাভানা অ্যাগ্রো লিমিটেড, সাভানা ন্যাচারাল পার্ক, সাভানা ইকো রিসোর্ট, সাভানা কান্ট্রি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছেন বেনজীর আহমেদ। বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড নামের একটি কোম্পানিতে বড় মেয়ে ফারহিনের নামে এক লাখ, আর ছোট মেয়ে তাহসিনের জন্য কেনা হয়েছে আরো এক লাখ শেয়ার। এম/এস একটি শিশির বিন্দু (রেজি. পি-৪৩০৩৬) নামের ফার্মের ৫ শতাংশের মালিকানায় নাম রয়েছে বড় মেয়ের। আরও ৫ শতাংশের মালিকানা রয়েছে ছোট মেয়ের। একই প্রতিষ্ঠানে বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জার রয়েছে ১৫ শতাংশের অংশীদারী। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানটিতে মোট ২৫ শতাংশের মালিকানা রয়েছে বেনজীর আহমেদের স্ত্রী ও মেয়েদের।
পুলিশের সদ্য সাবেক মহাপরিদর্শকের বিরুদ্ধে এত বড় দুর্নীতির অভিযোগে কি বাহিনীতে কোনো প্রভাব পড়তে পারে? পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই ধরনের খবর বাহিনীতে কোনো প্রভাব ফেলবে না। কারণ, বাহিনীর সদস্যরা প্রশিক্ষিত। কোনো ব্যক্তির বিষয় বাহিনীকে প্রভাবিত করে না।’
এমন দৃষ্টান্ত বাহিনীর অন্যদেরও দুর্নীতিতে উৎসাহিত করতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। যিনি দুর্নীতি করতে চান, তিনি এগুলো দেখেন না। তিনি নিজের মতো করে করেন। ফলে এই খবরের সঙ্গে বাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই।’
পুলিশের সাবেক আরেকজন মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলেন, ‘পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হলেই তো আর সেটা প্রমাণ হয়ে যায় না। এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এটা নিয়ে তদন্ত করা উচিত। যদি সত্যি তিনি অবৈধ সম্পদের মালিক হন তাহলে আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হতে পারে। এখানে বাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই।’
কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘রাজধানীর গুলশানে সুবিশাল অভিজাত একটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে বেনজীর আহমেদের। গুলশান ১ নম্বরের ১৩০ নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়িটির নাম ‘র্যাংকন আইকন টাওয়ার লেক ভিউ’। ভবনের ১২ ও ১৩তম তলায় আট হাজার ৬০০ বর্গফুটের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে তার। আট হাজার ৬০০ বর্গফুটের এই অ্যাপার্টমেন্টের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাজধানীর মগবাজার আদ-দ্বীন হাসপাতাল সংলগ্ন ইস্টার্ন প্রপ্রার্টিজের একটি বহুতল ভবনে চার হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনেছেন বেনজীর আহমেদ। পূর্বাচলে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বাড়ি করেছেন বেনজীর আহমেদ। আনন্দ হাউজিং সোসাইটির দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় পোড়া মোড়ের পাশের এলাকায় অন্তত ৪০ কাঠা জমির ওপর গড়েছেন বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি। জমি ও বাড়ির মূল্য কমপক্ষে ৪৫ কোটি টাকা বলে ধারণা স্থানীয়দের।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বেনজীর আহমেদ যেহেতু সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি ছিলেন, সে কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির তথ্য উঠে এলে অবশ্যই সরকারকে গুরুত্বসহকারে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। দুদকসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরের এ বিষয়ে বিশদভাবে অনুসন্ধানে নামা উচিত। সরকারের যেকোনো পর্যায়েই চাকরি করুন না কেন, বৈধ উপায়ে কোনোভাবেই এত সম্পদ অর্জন করা সম্ভব নয়। বেনজীর আহমেদ যদি সত্যিই এত সম্পদের মালিক হয়ে থাকেন, সেটি বিস্ময়কর। বেনজীর দুর্নীতি করে থাকলে সেটি চিহ্নিত করা উচিত। তার বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ অর্জনের উৎস ও সূত্রগুলো চিহ্নিত করতে হবে। তার দুর্নীতির পুরো চিত্র উন্মোচন করা উচিত। কারণ, আইন সবার জন্য সমান।’
সরকারি চাকরিতে থেকে একজন কর্মকর্তা যে এত সম্পদ অর্জন করলেন সেটা দেখার দায়িত্ব কার? সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘এটা দেখার দায়িত্ব দুদক ও এনবিআরের। কারণ, আমাদের প্রত্যেকের বছরে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হয়। সেটা তো অনুসন্ধান করা উচিত। অবশ্য কেউ যদি তার সম্পদের তালিকায় এগুলো না লেখেন, তাহলে তাদের পক্ষে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ১৬ লাখ সরকারি কর্মচারির সবার জন্য তো আলাদা করে অনুসন্ধান করার সুযোগ নেই। তারপরও যেগুলো সামনে আসে, সেগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান করা উচিত। কারণ, আইন সবার জন্য সমান। কেউ যদি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেন, দুদক তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।’